মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীকে নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে গবেষণা গ্রন্থ ‘মওলানা ভাসানী : রাজনীতি, দর্শন ও ধর্ম’। ড. মো. ফোরকান মিয়ার রচনা ও প্রফেসর ড. আবদুল লতিফ মাসুমের সম্পাদনায় বইটি প্রকাশ করেছে একাডেমিয়া পাবলিশিং হাউজ লিমিটেড (এপিএল)। এ উপলক্ষে শনিবার (২ এপ্রিল) বেলা ১১টায়  জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে প্রকাশনা অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ার উল্লাহ চৌধুরী বলেন, যে বইটি লেখা হয়েছে এটি অনেকটা গবেষণামূলক। লেখক অনেক শ্রম দিয়ে বইটি প্রকাশ করেছেন বলেই মনে হয়। ভাসানী যে মহাপুরুষ একজন বরেণ্য রাজনীতিবিদ সেটা নিয়ে আলোচনার অপেক্ষা রাখে না। আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তখন থেকেই তার সঙ্গে পরিচয়। মাওলানা ভাসানীর আবির্ভাব সামন্ত সমাজে। তার যে দর্শন, চিন্তা তা থেকেই সৃষ্টি হয়েছে সমাজতান্ত্রিক চিন্তার। তার জন্য প্রয়োজন বিদ্রোহ, বিপ্লব করতে হবে।

তিনি আরো বলেন, পৃথিবীর এই অঞ্চলের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে মওলানা ভাসানী এক অবিস্মরণীয় পিতৃপুরুষের নাম। উপনিবেশিক শৃঙ্খলমুক্তি তথা বৃটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা ছিলেন শীর্ষস্থানীয় তিনি তাদের একজন। পরবর্তীকালে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ বিরোধী স্বাধীনতার আন্দোলনে তিনিই ছিলেন উৎসমূল। মওলানা ভাসানী গ্রাম বাংলার পথে পথে বেড়িয়েছেন। অসহায় মানুষদের দুখ দুর্দশা সচক্ষে দেখেছেন। তার ধর্ম ইসলাম। তিনি ইসলামের মর্মবানীকে রাজনীতিতে প্রবেশ করিয়েছেন। শেখ মজিবকে তিনি পুত্রসম ভাবতেন।

প্রকাশনা উৎসবে মাওলানা ভাসানীর ভাইয়ের ছেলে এবংখাজা ইউনুছ আলী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ট্রেজারার এম এ রশিদ খান বলেন, মনে, মুখে ও কাজে এক ছিলেন ভাসানী। তিনি তিন পুরুষের নেতা ছিলেন। ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ তিন জাতির নেতা ছিলেন তিনি। ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক নেতা ছিলেন তিনি। তার মতো দ্বিতীয়জন আর পাওয়া যাবে না। মজলুমদের জন্য কাজ করে মজলুম নেতা হয়েছেন। বিশ্বের শান্তি ও কল্যাণকামী মানুষের সঙ্গে সৌহার্দ্য ছিল তার। বাঙালি জাতির যা কিছু অর্জন রয়েছে তার সবকিছুতে মাওলানা ভাসানীর অবদান রয়েছে।

রশিদ খান আরো বলেন, মাওলানা ভাসানীকে গান্ধীর সাথে তুলনা করলে ভাসানীকে ছোট করা হবে। ভাসানীর মর্তবা গান্ধীর চেয়ে অনেক উর্ধে। তিনি জাতির স্বার্থের সাথে কখনো বেইমানি করেননি। রাজনীতি ছিল তার কাছে একটি মহৎ কর্মপ্রয়াস। মূখে ও কর্মে তিনি ছিলেন সদা এক। এমন নেতা পাওয়া বর্তমানে খুবই দুষ্কর। তিনি ধর্মভীরু ছিলেন কিন্তু ধর্ম অন্ধ ছিলেননা। মজলুমদের জন্য কাজ করতে গিয়ে তিনি নিজেও মজলুম হয়েছেন। তার জীবনে তিনি ৫০ এর মত পত্রিকা উদ্বোধন করেন। তিনি ছিলেন বিশ্ব নেতা। দেশ ও জাতির স্বার্থে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। ১০০ এর বেশি আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দেন। তিনি জাতীয় জীবনের প্রেরণার উৎস।

বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অ্যাডভোকেট নাজমুল হক নান্নু বলেন, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন করেননি কেউ। ভাসানীই মানুষকে শিখিয়েছেন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন। ভাসানী রক্ষণশীল মুসলিম ছিলেন না। তিনি ইসলামী সমাজতন্ত্রের যে ধারণা দিয়েছিলেন, তাতে সমাজতন্ত্রকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। অর্থের লোভ ও ক্ষমতার মোহ ত্যাগ করে মানবতাবাদী রাজনীতির জন্য পৃথিবীর ইতিহাসে যে গুটিকয়েক রাজনীতিবিদ স্মরণীয় হয়ে আছেন মওলানা ভাসানী তাদের একজন। এজন্য তাঁর নামের সাথে স্বয়ংক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়েছিল। ‘মজলুম জননেতা’।

কবি, সাংবাদিক ও গবেষক অধ্যাপক আবদুল হাই শিকদার বলেন, তিনি ছিলেন প্রমিথিউসের মতো। সাম্রাজ্যবাদীদের থাবা থেকে দেশ ও জাতিকে উদ্ধারে তিনি ছিলেন সদা তৎপর। তিনি নির্দিষ্ট কোনো পন্থী ছিলেন না, তিনি ছিলেন মানবপন্থী। সবসময় শোষণ বিরুধী ছিলেন। জমিদার বিরুধী আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি বহুবাধার মূখে পড়েন। তার রাজনীতি ছিল কৃষক-মজুরের জন্য। তিনি ব্যক্তি জীবনে সরল ছিলেন কিন্তু ভন্ডামির সরল ছিলেননা। ভাসানী আমাদের বড় গাছ, যার তলে সবাই আশ্রয় নিতে পারে।

বইটির নানা বিষয় তুলে ধরে এর সম্পাদক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবদুল লতিফ মাসুম বলেন, মাওলানা ভাসানী নির্যাতিত মানুষের জন্য আজীবন কাজ করে গেছেন। সমাজতান্ত্রিক চিন্তার একজন মজলুম নেতা বাঙালির সব আন্দোলনের প্রেরণা।  বাংলাদেশের সার্থক স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন মাওলানা ভাসানী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে যথাযথ সম্মান করতেন। তার রাজনৈতিক গুরু হিসেবে ভাসানীকে অনেক ভক্তি শ্রদ্ধা করতেন। তিনি আরো বলেন মাওলানা ভাসানী সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে জিহাদ করে গেছেন। তিনি মানুষকে কোরআন ও হাদীসকে ব্যাখ্যা করে বুঝাতেন ও নিজে আমল করতেন। পাকভারত উপমহাদেশে ভাসানী মাহাত্যগান্ধীর মতোই অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন। তিনি পাকিস্তানী সরকারের শোষনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। মজলুম জনতার পক্ষে কথা বলতে ও লড়তে গিয়ে তিনি দীর্ঘ ৯ মাস কারাবন্ধী ছিলেন। তার ধর্ম বিশ্বাস ছিল রাজনীতির অন্যতম উপাদান। ধর্মীয় মূল্যবোধকে তিনি রাজনীতিতে নিয়ে এসেছেন। বঙ্গবন্ধু যদি জাতির পিতা হন, তাহলে ভাসানী হলেন জাতির দাদা।

সাপ্তাহিক হক কথা সাবেক সম্পাদক এবং মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় খণ্ডকালীন শিক্ষক সৈয়দ এরফানুল বারী বলেন, ভাসানী এতো বড় কঠিন সত্য যে তাকে বড় করার জন্য মিথ্যা কাহিনী রচনার দরকার পড়েনা। তার সাথে ছিল আমার অন্তরঙ্গ সম্পর্কতা। আমি সবাইকে তার গ্রামের বাড়ি ভ্রমনের আহবান করছি। সেখানে তিন বেলা ফ্রী খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। তার সম্পর্কে চমকপ্রদ কথা বলা সহজ কিন্ত তাকে ধারণ করা কঠিন। তিনি মসজিদে বাংলা খুতবা দিতেন। সব ইমাম ও খতীবদের বাংলায় খুতবা দেওয়ার আহবান করে গেছেন।

অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশে (ইউল্যাব) অধ্যাপক ড. সলিমুল্লাহ খান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবুল কাশেম ফজলুল হক।  বক্তারা বলেন, অর্থের লোভ ও ক্ষমতার মোহ ত্যাগ করে মানবতাবাদী রাজনীতির জন্য পূর্ণ বীর ইতিহাসে যে গুটিকয়েক রাজনীতিক স্মরণীয় হয়ে আছেন মওলানা ভাসানী তাদের একজন। এ জন্যই তার নামের সাথে স্বয়ংক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়েছিল ‘মজলুম জননেতা’। তিনি ছিলেন ডানপন্থী বামপন্থী, ইসলামপন্থী-সমাজ সবারই ভরসার জায়গা বা আশ্রয়স্থল। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন শোষণমুক্ত সমাজতন্ত্র, ইসলামী সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্রকামী নেতা। তিন পুরুষ ও তিন জাতির নেতা ছিলেন তিনি। নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পাশাপাশি অনিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করেছেন মাওলানা ভাসানী।’

বইটির রচয়িতা ড. মো. ফোরকান মিয়া বলেন, মওলানা ভাসানী : রাজনীতি, দর্শন ও ধর্ম গ্রন্থটি এতদসংক্রান্ত আমার গবেষণার ফসল। এ গ্রন্থে আমি মওলানা ভাসানীর বিশ্বাস, রাজনৈতিক চর্চা ও ধর্মচিন্তার একটা বিশ্লেষণ তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। প্রগতিশীলরা ও ইসলামপন্থীরা তাঁকে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। মূলত প্রগতিশীল রাজনীতি ও ইসলামী রাজনীতি তথা সমাজতন্ত্র ও ইসলামের মধ্যে তিনি কীভাবে সমন্বয় করেছেন তারই একটি বিশ্লেষণ এই গ্রন্থ। এছাড়া তাঁর রাজনৈতিক কর্মপদ্ধতি ও বাস্তবায়ন কৌশল এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুতে তাঁর অবস্থান নিয়ে যে বিতর্ক আছে তার একটা নির্মোহ পর্যালোচনা সন্নিবেশিত হয়েছে এ গ্রন্থে।

একাডেমিয়া পাবলিশিং হাউজ লিমিটেডের (এপিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. এম আব্দুল আজিজ সভাপতির ভাষণে বলেন, কাউকে খাটো বা বড় করার জন্য নয় বরং প্রত্যেক জাতীয় ব্যক্তিত্বদের শ্রদ্ধার সাথে নির্মোহ ভাবে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা উচিত। এরই অংশ হিসেবে মওলানা ভাষানীকে নিয়ে এদেশে একাডেমিক চর্চা আরো বাড়ানো দরকার এবং প্রাইমারী থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত তাঁর জীবনী পাঠ্যভুক্ত করা উচিত। পরিশেষে সভাপতি উপস্থিত সকলকে ধন্যবাদ দিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।