আইন আইনর্সবস্বতা এবং সংস্কার  গ্রন্থের মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে সংস্কার (reformation)। তবে ইসলামের সংস্কার নয়, কারণ ইসলামের সংস্কার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন মুসলিমদের প্রচলিত ধ্যানধারণা, রীতিনীতি, আচার-আচরণের সংস্কার। মুসলিম উম্মাহর বিপর্যস্ত অবস্থার মূলে রয়েছে ইসলামের মৌলিক মূল্যবোধগুলোর ব্যাপারে ব্যাপক অজ্ঞতা এবং অবহেলা। আর তাই এই বইটি জুড়েই তুলে ধরা হয়েছে মূল্যবোধমুখী ধারা।

সময়ের ধারাবাহিকতায় আমরা যা শরিয়া বলে জানি ও মানি তা মূলত আসমানি নয়, বরং ভুলভ্রান্তির সম্ভাবনাময় স্কলারদের ধারণা ও অবদানে সমৃদ্ধ একটি জটিল ভান্ডার, যাতে ইসলামের সঞ্জীবনী পথনির্দেশনা আর জীবনের বাস্তবতার মধ্যে বড় রকমের ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছে এবং সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে মুসলিম সমাজের ইসলামী ও মানবিক ধারায় উন্নতি ও অগ্রগতির পথে আকাঙ্ক্ষিত ভূমিকা রাখতে কার্যকরী হচ্ছে না।

নিছক জাল হাদিস নয়, বরং দুর্বল হাদিসের ওপর নির্ভর করা একটি বড় সমস্যা। দৃষ্টান্তস্বরূপ, হুদুদ আইনের বিভ্রান্তিকর প্রয়োগ কুরআন এবং নবিজীর বাণীর সাথেই সাংঘর্ষিক নয়, বরং এক ধরনের অকার্যকারী ও বেইনসাফী প্রয়োগ। এর অনিবার্য পরিণাম হচ্ছে শরিয়া প্রবর্তন অথবা বাস্তবায়নের নামে মুসলিম সমাজের বিবিধ দুর্বলতম গোষ্ঠীর প্রতি জুলুম এবং ইসলামের অপব্যবহার। এই বিভ্রান্তি ও অপপ্রয়োগ প্রাসঙ্গিক প্রমাণাদি ও বিশ্লেষণসহ সমগ্র বইটি জুড়েই আলোচিত হয়েছে।

এই বইটিতে মূলত পাঁচটি অধ্যায় রয়েছে। প্রথমে পরিচিতিমূলক অধ্যায়ের পর দ্বিতীয় অধ্যায়ের ফোকাস হচ্ছে শরিয়া এবং এর শাব্দিক, পারিভাষিক এবং প্রায়োগিক দিকগুলোর পর্যাপ্ত বিশ্লেষণ, বিশেষ করে যেখানে শরিয়া অনেক ক্ষেত্রেই আইনসর্বস্বতায় (legalism) পর্যবসিত হয়েছে ও হয়। তৃতীয় অধ্যায়ের ফোকাস হচ্ছে হাদিস, যেখানে হাদিসশাস্ত্র এবং এর চর্চা আর ইসলামী বিধিবিধান নিরূপণ অথবা আহরণে অনেক ক্ষেত্রে হাদিসের অপপ্রয়োগ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে।

চতুর্থ অধ্যায় ইজমা (সর্বসম্মত ঐকমত্য) নিয়ে। এখানে দেখানো হয়েছে যে, যেসব বিষয়ে ইজমার দাবি করা হয়। তার অধিকাংশই সঠিক নয়, বিশেষ করে উসুলে ফিকহের অন্যতম অংশ হিসেবে ইজমার সংজ্ঞাসহ বিবিধ বিষয় নিয়ে কোনো ইজমা নেই। পঞ্চম অধ্যায় কিয়াস বা তুলনামূলক যুক্তি নিয়ে, যেখানে ইসলামী বিধিবিধান আহরণ ও প্রণয়নে ধারণাগত এবং প্রায়োগিক বিবিধ বিষয়ে বড় রকমের সমস্যার ওপর বিস্তারিত আলোকপাত করা হয়েছে। এরপর ষষ্ঠ অধ্যায়ে প্রচলিত ইসলামী আইন সম্ভারের পেছনে এস্পিরিক্যাল ভিত্তি নিয়ে অবহেলা এবং তার ফলাফলের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে।

এম্পিরিক্যাল ভিত্তির ব্যাপারে অবহেলার কারণে সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে ইসলামী বিধিবিধানের ক্ষেত্রে জীবনঘনিষ্ঠ গবেষণাভিত্তিক ধারার পরিবর্তে যে আক্ষরিক এবং কিতাবসর্ব ব্যাখ্যা- বিশ্লেষণের ওপর অত্যধিক জোর দেওয়া হয়ে থাকে তার কুফল হিসেবে ইসলামী আইনী ধারায় যে ভারসাম্যের হ্রাস হয়েছে, কিভাবে তা থেকে উতরানো যায় সেবিষয়ে বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে। গ্রন্থকার দৃঢ়ভাবেই বিশ্বাস করেন যে, মুসলিম বিশ্বে বিরাজমান অবস্থার পরিবর্তন আশা করা যেতে পারে না, যতক্ষণ না ইসলামের বুনিয়াদি উৎসগুলো নিয়ে কুরআন এবং নবিজীর ঐতিহ্যের আলোকেই মুসলিম চিন্তা ও বুঝের যথাযথ মূল্যায়ন হয় এবং সংস্কার আসে।